হাসন রাজা ও তাঁর ভাবের জগৎ

মম আঁখি হতে পয়দা আসমান জমি

আঁখি মুন্জিয়া দেখ রুপরে আঁখি মুন্জিয়া দেখ রুপ
আর দিলের চক্ষে চাহিয়া দেখ বন্ধুয়ার স্বরুপ

মাটির পিন্জিরার মাঝে বন্দি হইয়ারে
কান্দে হাসন রাজার মন মুনিয়ারে

বিচার করি চাহিয়া দেখি সকলই আমি …

হাসন রাজা তো মৈরব না
ঘর ভাঙিয়া ঘর বানাব ভেবে দেখ না।

আমি করি রে মানা, অপ্রেমিকে গান আমার শুনবে না।

উদ্বৃত পঙক্তি/ চরনগুলোকে হাসন রাজার ভাবুক মন ও ভাবুকতার সূত্রমুখ হিসেবে উপস্থাপন করে আমরা আলোচনাকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে পারি।হাসন রাজা নিঃসন্দেহে একজন উচ্ছমাপের ভাবুক, সাধক ও মরমি কবি ছিলেন। তাঁর অজস্র গানই এর সাক্ষ্য বহন করে। এমনকি তাঁর গানের ভাবসম্পদ আমাদের বিস্মিত করে এই জন্য যে, পৃথিবীর/ভারতবর্ষের এক প্রতন্ত গ্রামে জন্মগ্রহন/বসবাস করেও একজন অক্ষরঙ্গানসম্পন্ন মানুষ কীভাবে এরুপ গভীর জীবনবোধে আচ্ছন্ন ও ভাবের জগতে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে পারলেন, তাও জগৎ-জীবন-ধর্ম ও দর্শনের সঙ্গে পরম্পরা বজায় রেখেই।

হাসন রাজা জমিদারনন্দন ছিলেন। বিদ্যালয়ে কতটুকু লেখাপড়া করেছেন, এ-ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে কিছুই জানা যায় না, শুধু এইটুকুই জানা যায় তিনি নাম দস্তখত জানতেন। মুখে মুখে গান বাঁধতে পারতেন, নিজে লিখতেন আর অন্যকে দিয়ে গান লিখিয়েও নিতেন। মাত্র সতেরো বছর বয়সে হাসন রাজা জমিদারির দায়িত্ব হাতে নেন; জমিদার হিসেবে তিনি ছিলেন প্রতাপশালী, নিষ্ঠুর, উৎপীড়ক ও অহংকারী। তাঁর নারীপ্রীতি ছিল কিংবদন্তিতুল্য; একধিক বিয়ে, বহুনারী পরিবৃত হয়ে নাচগানের আসর তারি নিদর্শন। প্রথম জীবনে জমিদার/সামন্তসুলভ এ-সব ভোগবিলাসি হয়তো তাঁকে ধীরে ধীরে বৈরাগ্যের পদিকে ঠেলে দেয়; এতটাই পরে বৈরাগ্য হয়ে ওঠেন যে, তিনি বিশাল জমিদার হয়েও দিন যাপন করতেন এক সামান্য/সাধারন মানুষের মতোই! তিনি হয়ে ওঠেন অদ্ভুত এক মানুষ-ভাবুক ও দার্শনিক। জীবনের নশ্বরতা/অনিত্যতা, পার্থিব সুখের ক্ষণস্থায়িত্ব, ভোগ ও ইন্দ্রিয়বিলাসের ভেতরকার শূন্যতা তাঁকে নিরাশবাদী ও ধ্যানী করে তোলে। সমূহ পার্থিবতা থেকে চোখ সরিয়ে তিনি দৃষ্টি দেন আপন সত্তার মুকুরে। সেখানেই তিনি দেখা পান নিজের স্বরুপের, পরম এক জনের। আর তাঁর দিব্যদর্শন তাঁকে প্রেমিক করে তোলে। প্রেমে দিওয়ানা হাসন বন্ধুর জন্য নাচে-গায় আর ছুটে বেড়ায় জল-স্থল- অন্তরিক্ষে। সেদিক থেকে দেখলে হাসন রাজার ভাবজগতের তিনটি স্তর স্পষ্ট। প্রথমত, শরিয়তের আইনকানুন বাস্তব জীবনে রুপায়ন; দ্বিতীয়ত, প্রেমের মাধ্যমে প্রিয়াকে লাভ করার চেষ্টা এবং তৃতীয়ত ও সবশেষে, দার্শনি রুপে তাঁর নিজের মধ্যেই প্রিয়জনের সাক্ষাত ও সান্নিধ্য লাভ। এই ত্রিবিধ কর্মপদ্ধতি ও সাধনার মধ্যেই হাসন রাজার ভাবচিন্তা ও দর্শনের মৌল স্বরুপ নিহিত।


হাসন রাজা ছিলেন সত্যের অন্বেষনে নিবেদিত এবং জীবন ও সত্তার অর্থ আবিষ্কারে ব্রতী; ভারতবর্ষের মানসতীর্থ রচনার উত্তর সাধক। তাঁর মধ্যে যেমন ইরান-তুরানের সুফিবাদি ভাবদর্শনের মগ্নচেতনা ক্রিয়াশীল ছিল, তেমনই ছিল মধ্যযুগের ভারতের রজ্জব, রামানন্দ, কবীর দাদু, রবিদাস নানক প্রমুখ ভাবুকের ভাব, চিন্তা ও মনীষায় সুগভীর জয়বার্তা। সর্বোপরি এ-সঙ্গে প্রযুক্ত ছিল দেশীয় হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মদর্শন ও লোকায়িত ভাব-ভাবনার ধারনা ও চিন্তা। তাঁর এরুপ ভাব-চিন্তন ও মানসগঠনে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটও জড়িত। অন্তত বঙ্গদেশে তথা সিলেটের সংস্কৃতিক পরিমন্ডল গঠনে বহু ধর্ম-দর্শন-পুরানের সমন্বয়ে গড়া মরমি ধারা ও নানা লোকধর্মের মানবিক চৈতন্যে ভাস্বর সাধনপদ্বতি প্রতিফলন ও প্রভাব। বিদ্বানদের বরাত দিয়ে বলা যায়, সিলেটের লোককবি ও সাধকেরা বৌদ্ধ, বৈষ্ঞব, সুফি, বাউল প্রভৃতি চিন্তা-চেতনার পন্থাকে মিলিয়ে মিশিয়ে গ্রহন করেছেন। সুফিপন্থার মারফতি ভাবধারার মধ্যে গৌড়ীয় বৈষ্ঞবধর্ম প্রভাবিত বাউলধর্ম এখানে নতুন পথ খুঁজে পেয়েছিল। ফলে ত্ত্ত্বঙ্গানমূলক সুফিবাদের সঙ্গে যোগক্রিয়ামূলক বাউল ধর্মেরও মিশ্রন ঘটে এবং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৌদ্ধ নাথপন্থিদের দেহাত্ববাদী তান্ত্রিক সাধনার ধারা। এবং এই পটভূমিকায় হাসন রাজার ভাবজগৎ ও সাধনা বিচার্য বলে হাসন রাজার ‘আল্লা’ আর ‘কানাই’ এক ও ভেদাভেদ শূন্য। একইভাবে সুফি সাধনার ‘ফারা’র সঙ্গে বৌদ্ধবাদের ‘নির্বাণত্ত্ব’ও তাঁর ভাবনায় ও সুরে একাকার হয়ে গেছে।

সাংস্কৃতিক সাতন্ত্রে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সিলেট জনপদ ঐতিহ্যগতভাবেই ভাবুক ও ভাবসাধনার উর্বর ভূমি। সিলেটের লোককবিদের মধ্যে যারা আউল-বাউল ছিলেন তাদের সঙ্গে যেমন বাংলার অপরাপর বাউলদের একটু প্রার্থক্য ছিল, তেমনই ছিল তাঁদের মধ্যে একটা ফকিরি ঘরানা। সিলেটের এই ফকিরি ঘরানা কবিদের বেশিরভাগই ছিলেন মারফতিপন্থি বাউল। যদিও এরা প্রচলিত ঘরনার বাউল ছিলেন না। হাসন রাজাও তাই সৈয়দ শাহনুর, ছাবাল শাহ, শীতালং শাহ, আরকুম শাহ, রকীব শাহ, শাহ আব্দুল করিম প্রমুখের মতো ফকিরি ঘরানার একজন সাধক। অপরাপর সাধকদের মতই তিনি সুফি ও বৈষ্ঞব ভাবনাকে আত্নস্থ করে তাঁর ভাবসাধনার পথকে প্রশস্ত করেছেন। কেননা গোটা মধ্যযুগ ধরেই সিলেট যেমন ছিল সুফিবাদী সাধক/পির আউলিয়ার বিচরণভূমি, তেমনি চৈতন্য ও চৈতন্যপ্রভাবে ভক্তিবাদী সাধক অদ্বৈতাচার্যের পিতৃভূমি হিসেবে বৈষ্ঞব প্রেমধর্ম ও ভক্তিবাদী সাধনার ধারা এখানকার মৃত্তিকার গভীরে প্রবেশ করে জাতি’ধর্ম’বর্ণ নির্বিশেষে ভাবুক-চিন্তক ও মরমিয়া সাধকদের আপ্লুত করে রেখেছিল। হাসন রাজার মরমি মানসও এই পত্রপল্লবেই আচ্ছাদিত।
বাংলার সুফিদের আধ্যাত্বিক সাধনার পথে ও নৃত্ব-বাদ্য ও জিকির একটা অবশ্যকর্তব্য ছিল; আবার বৈষ্ঞব সাধকরাও প্রেমভাবে দিব্যোন্মাদ হয়ে সাধনামর্গে পৌঁছতেন। হাসন রাজা চিশতিয়া সুফি তরিকার পিরের মুরিদ ছিলেন। তিনি যে নৃত্য-গীত-বাদ্য সহযোগে প্রায়ই দিব্যোন্মাদ হয়ে যেতেন, ভাওয়ালি নৌকায় ভেসে ভেসে ধে্ই ধেই করে চক্রাকারে নৃত্য করতে করতে গান গাইতেন, খোবসুরত রমণীদের মধ্যখানে তা নানা সূত্রে জানা যায়; তাঁর বিভিন্ন গানেও এই ধরনের ভাব ও সাধনার ইঙ্গিত পাওয়া যায় ( হাসন রাজা হইল পাগল, লোকের হইল জানা/ নাচে নাচে, ফালায় ফালায়, আর গায় গানা অথবা নাচে নাচে হাসন রাজা হাতে দেয় রে তালি/বন্ধের বাড়ির মানুষ আইলে করে কোলাকুলি অথবা উন্মাদ হইয়া নাচে, দেখিয়া আল্লার ভঙ্গি/ হুসমুস কিছু নাই হইয়াছে আল্লার সঙ্গি ) । আবার রাধা ও কৃষ্ঞ রুপকে তাঁর যে পাগলপারা প্রেমভাব তা তাকে সমন্বয়বাদী ভাবুক হিসেবেই প্রতিপন্ন করে। এবং এসব সমন্বয়পন্থার ভাব, বাণী ও সাধনা গণমুখী ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সাধনারই উত্তরাধিকার।


হাসন রাজার ভাব-ভাবনার বুনিয়াদ হচ্ছে আত্নমুখীনতা। আমি কে? এই চির ভাবুকতার প্রশ্ন তাঁরও প্রথম প্রশ্ন ( আমার মাঝে কোন জন, তারে খুজল না ) এবং পরের জিঙ্গাসা হচ্ছে তাঁর– কেন এই আমি?( হাসন রাজা ভাবিয়া দেখ মনে/এভবে আসলায় ওরে তুমি কেনে?) এই আত্নজিঙ্গাসাই হাসন রাজাকে ক্রমে ‘বাউলা’ ‘আশিক’ ও ‘পাগল’ করে তুলেছে। এবং তিনি এগিয়ে গেছেন ভাবুকতার পথ বেয়ে সাধন-ভজনের দিকে। জগৎস্রষ্টারুপি অরুপ সত্ত্বা ও সত্যের দিকে। তাঁর চিন্তাসূত্রের সঙ্গে মনসুর হাল্লাজের ‘আনাল হক’ (আমিই সত্য) এবং উপনিষদের ‘আত্নানাং বিদ্ধি’ অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে গেছে। ব্রন্ধ্যঙ্গান বিষয়মুখিন হলেও মূল ভাবনা তো একই। হাসন রাজা তাই অনায়াসেই অনুসিদ্ধান্ত নেন : আমার পরিচয় করেয়েছি/ সবই তুই আমিত্ব ছাড়িয়ে দিয়েছি অথবা তুমি আমি ভিন্ন নহি, একই হইয়াছি। হাসন রাজার এই ‘আমি’ রুপি সত্ত্বা সুফিবাদী অসীমেরই একক ধারনা মাত্র। সুফিতত্ত্বের আশিকে-মাশুকে একাত্ন হওয়া আর বৈষ্ঞবতত্ত্বের অদ্বৈতবাদ অর্থাৎ ‘আমিই ব্রদ্ধ’ এর মধ্যে একটা ধারনাগত ঐক্য হাসন রাজাকে প্রভাবিত করেছিল বলেই তার আত্নমুখীন ধারনা তাঁকে বলিয়ে নিয়েছে : মম আঁখি হইতে পয়দা আসমান জমিন কিংবা আমি হইতে সর্বোৎপত্তি হাসর রাজায় কয়। তাঁর ভাবনায়, আমি হতেই ঈশ্বর, আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে। আমি হতেই জগৎ ও ধ্বনি সৃষ্টি। আমি সুন্দর, আমি বংশ, আমি ভিতর ও বাহির, চিন্তা ও বাক্য, অপ্রকাশ ও প্রকাশ। আমার বুদ্ধি হতে সৃষ্টি হয়েছে ভগবান, আমার চক্ষু হতে সৃষ্টি আকাশ ও পৃথিবী– এই দৃশ্যমান জগৎ; এরুপ আমার কর্ণ হতে সৃষ্টি হয়েছে এই ধ্বনি, এই শব্দ; আমার শরীর হতে সৃষ্টি হয়েছে শক্ত ও নরম, ঠান্ডা ও গরম, এই স্পর্শ; আমি নাসিকা দ্বারা সৃষ্টি করেছি এই গন্ধ; আমি জিহবা দ্বারা সৃষ্টি করেছি এই রস–মিষ্টতা ও তিক্ততা। সুফি সাধক জালালউদ্দিন রুমী যেমনটা বলেছিলেন : আমার সত্তা হতে পৃথিবীর সবকিছুরই উৎপত্তি। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যটি বড় প্রসঙ্গিক : এই সাধক দেখিয়েছেন যে, শাশ্বত পুরুষ তাহার ভিতর হইতে বাহির হইয়া তাহার নয়নপথে আবির্ভুত হইলেন। বৈদিক ঋষিও এমনিভাবে বলিয়াছেন যে, যে পুরুষ তাহার মধ্যে তিনি আদিত্য মন্ডলে অধিষ্ঠিত। সর্বোপরি হাসন বলেন, আমার জন্ম নাই, মৃত্যু নাই; আমার তো আদি ও অন্ত নাই; জীবের তো শেষ নাই, সে তো চিরকাল জীবিত; আম আপনাকে চিনিয়াছি– আপনাকে চিনলে ‘তাহাকে’ চিনা যায়।

এই যে পরম সত্তা, যার খন্ডিত রুপ এই ‘আমি’–সে দেখতে আদতে কেমন? হাসন রাজা বার বার বলেছেন চর্মচক্ষে তাকে দেখা যায় না; তাকে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় না। তাঁর রুপ/স্বরূপ প্রত্যক্ষ করতে হবে ‘আঁখি মুন্জিয়া’। কেনান এই প্রেমাস্পদ বাইরের জগতের কোনও সৌন্দর্য-সত্তা নন; তিনি জগৎ বহির্ভূত কোনও খােদাও নন। এই তুমি-আমিতে কোনও ভেদাভেদ নেই। তাই তাকে দিলের চোখেই অনুভব ও উপলদ্ধি করতে হবে। হাসন রাজা আপন রুপ দেখে তাই চিৎকার করে ওঠেন– রুপ দেখেছি, চক্ষে আপনার রুপ দেখেছি! আমার মধ্য হতে বের হয়ে আমার রুপ আমাকে দেখা দিলো। ত্রিভুবন জুড়ে এই রুপ ঝলক দিচ্ছে, চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তাঁরা এই রুপের অতলে ডুবিয়া গিয়াছে, আমি বিশ্বময়। আমার এই রুপের মাধুর্যে আমি পাগল হয়ে গিয়েছি। আর এই যে অরুপরতন তাকে ধরতে/ছুঁতে/পেতে গেলে প্রেমের আগুনে পুড়তে হবে, প্রেমের পথেই চলতে হবে।

প্রেম ছাড়া মাশুককে পাওয়া যায় না। সুফিরা প্রেম-উন্মাদ। প্রেম-সম্পর্কের মধ্য দিয়েই পর্যায়ক্রমে মানুষের আমিত্বের বিলুপ ঘটে। সুফিমতে, এ হচ্ছে ‘ফানা’। এ-পর্যায়ে মানুষ স্রষ্টার সঙ্গে একলীন হয়ে যায়। হাসন রাজা বার বার তাঁর প্রেমসাধনা ও আত্নমুক্তির পথে এই ‘ফানা’র কথা বলেছেন (আল্লার রুপ দেখিয়া হাসন রাজা হইয়াছে ফানা/ নাচিয়ে নাচিয়ে হাসন রাজায় গাইতেছে গানা)। তবে এই ফানার পথ শাস্ত্রিয় মতে ও পথে নয়। বরং হাসন রাজা শাস্ত্রীয় অনুশাসনকে সিদ্ধির পথে বাধা, যান্ত্রিক ও অগভীর বলে উড়িয়ে দিয়ে শাস্ত্রকারদের অস্বীকার করেছেন (হাসন রাজায় বলে আমি না রাখিব জুদা/ মুল্লা মুনসীর কথা যত সকলই বেহুদা)। এমনকি সাধনার এইসব মেকি কারিগড়দের প্রতি বিদ্রুপবাণও ছুঁড়ে দিয়েছেন (চোখ থাকিতে দিনের কানার মত নাহি লই/ সাক্ষাতে যে বন্ধু খাড়া মুল্ল বলে কই?/ হাসন রাজার বন্ধুকে মুল্লা নাহি দেখে/ আজলের আন্ধি লাগছে কট মুল্লার আঁখে)। হাসন রাজার সাথে এইখানে অদ্ভুত মিল কবীরের দোহার : ‘সাধো পাঁড়ে নিপুণ কসাই’ (সাধু-পুরোহিত বড় নিপুণ কসাই), ‘মুল্লা হোকর বাংগ যো দেবে/ ক্যা তেরা সাহব বহরা হৈ’ (মুল্লা যে এত চিৎকার করে, প্রভু কি কানে শোনেন না?) ‘মুরতসে দুনিয়া ফল মাগৈ, আপনে হাথ বানায়ে’ (দুনিয়া নিজ হাতে বানানো মূর্তির কাছে ফল চায়) ইত্যাদি। একই পথের পথিক হাসন রাজাও প্রচলিত বেহেশত, দোযখের আস্থায় আস্থাশীল নন (বেস্ত দোযখে বন্ধু নিও না গো মোরে/ বন্ধু ছাড়িয়ে থাকবো না গো এই মনে কয়/ পুরাও আকাঙ্কা মোর অঙ্গে করিয়ে লয়)। তাই নামাজ কালামের পথও তার সাধনার পথ নয়। (আমি নামাজ পড়মো কেমনে দিয়া/ যে দিকে ফিরাইন আঁখি সে দিকে যে প্রান প্রিয়া)। সুতরাং তার সাধনা অন্যতর, অর্থাৎ শাস্ত্রীয়/সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির ঊর্দ্বে সর্বজীবে দয়া ও প্রেমের সাধনা। ভাবুক দাদু বলেছিলেন, ‘সেবা দ্বারা তাঁহাকে পাইব’। এ-রকম ব্রত শেষ জীবনে হাসন রাজাকে পেয়ে বসেছিল বলে আমাদের মনে হয়। কবীরের মতো এই মরমি কবি বলেছেন, প্রেমের মাধ্যমে তাঁকে জয় করব’ (খোদা মিলে প্রেমিক হইলে/পাবে না পাবে না খোদা নামাজ রোযা কইলে)। আমার জেনেছি হাসন রাজা রাস্তার একটা বিড়াল বাচ্চাকেও কোলে তুলে নিতেন, পরম মমতার সঙ্গে পশু-পাখি পালতেন, গভীর রাতে নিজ হাতে ভিখিরিকে খাবার খাইয়ে দিতেন। ঘুম থেকে উঠে চিল, কাক, চড়ুই প্রভৃতি পাখিকে ভাত-চাল-মাছ দিতেন। এমনকি মাছি ও পিঁপড়ার প্রতিও সদয় ব্যবহার করতেন। হিন্দুদের মনে আঘাত লাগার কথা ভেবে তাঁর প্রিয় মাতার শ্রাদ্ধ-অনুষ্ঠানে গরু জবাই করেন নি। আবার তিনি তাঁর হিন্দু প্রজাদের যেমন মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন তেমনি নিজ উদ্যোগে কালিপূজাও করিয়েছেন। আর তার কারন একটাই, সে হলো প্রেমের নেশা (নিশা লাগিল রে বাঁকা দুই নয়নে/ নিশা লাগিল রে/ হাসন রাজা পিয়ারির প্রেমে মজিল রে)। এই নেশার মূলে তাঁর অন্তরতম প্রিয়া পিয়ারি, যাকে তিনি বিভিন্ন নামে ডাকেন– আল্লা, রহিম, কৃষ্ঞ, রাধা, কালী, দিলারাম, প্রান, জান, মনোমোহিনী, রঙের বাড়ই, বন্ধু, মা প্রভৃতি। যে নামেই ডাকুন না কেন হাসন রাজা তাঁকে নিজের গূড় সত্তার মধ্যে উপলদ্ধি ও পাবার সাধনা করেছেন স্বনির্দেশিত পথেই।

হাসন রাজা ছিলেন নিখিল মানুষের ভাই। তীব্র জীবন-পিপাসা, প্রেম ও বৈরাগ্য তাঁর জীবনের মর্মমূলে গাথাঁ ছিল। বৈরাগ্যের বীজ তাঁর যৌবনের ভোগ-বিলাসের মধ্যেই ছিল উপ্ত; পরিনত বয়সে যা মহিরুহে পরিনত হয় অর্থাৎ ভাবরসে মজে তিনি হয়ে ওঠেন বিষয়বিবাগী। ভাব-ভাবনার ক্রমবিকাশের পথ বেয়ে হাসর রাজা ভোগবাদী থেকে মরমিবাদীতে রুপান্তরিত হন। উপলব্ধি করেন ভাগ্যদোষে আত্না দেহের মাঝে বন্দি হয়ে আছে (মাটির পিন্জিরার মাঝে বন্দি হইয়া রে/ কান্দে হাসন রাজার মন মুনিয়া রে)। তিনি আত্নার মাঝেই পেয়েছিলেন মানুষের পূর্ন পরিচয় এবং ‘আমি’র ভেতর দিয়ে আত্নদর্শনের চরম অভিব্যক্তি। এই পরিচয় ও অভিব্যক্তির সূত্র হলো তাঁর ভগবৎপ্রেমের উচ্চানুভূতি এবং সে প্রেমাস্পদ পরমাত্নার প্রতি মিলনের জন্য তীব্র আকাঙ্খা। এজন্য তিনি আশিক রুপে সাধনা করে গেছেন। এই সাধনা ঙ্ঞানযোগের নয়, সহজাত উপলব্ধির, প্রেমের। আর এই প্রেম নিখিল মানুষের, বিশ্বজনীন ও সত্যদর্শনের।

মুল লেখক (জফির সেতু)
যুগভেরী ঈদসংখ্যা ২০১৫ থেকে সংগৃহিতhason-raza1

লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়।

Leave a comment